স্বীকৃতি
এই গত মাস চার-পাঁচে প্রতিটি মানুষেরই
জীবন বদলেছে কিছুটা হলেও। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছিল আমাদের। অর্থাৎ হাতে ইমার্জেন্সি
ওয়ার্কার লেখা একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল-হাতে ধরে করতে হবে এমন নতুন
এক্সপেরিমেন্ট শুরু কোরো না। পুরোনোগুলো শেষ করার জন্য যেমন যেমন আসতে হবে তেমন তেমন সময়ে এসে শেষ করো। আর বাকি লেখালেখি বা ডেটা
এনালাইসিস এর কাজ ঘরে বসেই করো। সেই মতো সপ্তাহদুয়েক বাড়িতে থেকে কাজ করলাম।
প্রতিদিন সকালে কাজের ফিরিস্তি দিতে হতো ইমেইলে। সাপ্তাহিক মিটিংগুলো যেমন চলার
চলছিল। তফাৎটা শুধু বাড়ি থেকেই জ্যুমের মাধ্যমে সারা যাচ্ছিলো। তারপর আরো সপ্তাহ
দুয়েক সকাল আর বিকেলের শিফটিং ডিউটির মত করে ল্যাব মেম্বারদের মধ্যে কাজের সময় ভাগ
করে দেওয়া হলো। যাতে সকলে একই সময়ে ল্যাবে গিয়ে জড়ো হতে না পারে। অর্ধেক সময় কাজ করা যাবে।
এই সময় থেকেই আবার নতুন এক্সপেরিমেন্টগুলো করার বাধা থাকলো না। ফলে কাজ এগোতে
থাকলো আস্তে আস্তে। তারপর গত সপ্তাহ থেকে ইউনিভার্সিটির 'বাড়িতে থেকে কাজ' করার
পলিসি বন্ধ হতে আমরা সাধারণ সময় অনুসারেই সকাল সকাল ল্যাবে গিয়ে পূর্ণ উদ্যমে আমাদের কাজ করছি। তবে সারাদিনই সকলের মুখেই মাস্ক। এবং ক্যাফেটেরিয়াতে
বসে খাওয়া বা সেমিনার হলে বসে সেমিনার শোনা এসব সঙ্গত কারণেই বন্ধ। কাজ থেমে নেই কোথাওই। আমাদের ল্যাব থেকেই এর
মধ্যেই জ্যুমের মাধ্যমে একজন পিএইচডি থিসিস ডিফেন্ড করে ডিগ্রি পেলো। তিন তিনটি
রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশিত হলো।
ওই অর্ধেক সময় কাজ করার অনুমতি পাওয়া
গেলো যখন, তখনকার একটি ঘটনা বলি। কাজ সেরে বিকেলে বেরিয়েছি বিল্ডিং এর পিছনের দরজাটা দিয়ে। এই দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডাইনে গেলে হাসপাতালের
এমার্জেন্সি। তার সামনের রাস্তাটা, যেটা বাঁয়ে একটা নব্বই ডিগ্রী মোচড় দিয়ে সোজা বড়
রাস্তায় মিশেছে, সেটি গত দুই মাস বন্ধ। সে জায়গায় সম্ভাব্য কোভিড রোগীদের টেস্টিং এর জন্য
স্যাম্পল কালেকশনের অস্থায়ী তাঁবু খাটানো হয়েছে। ফলে ঐরাস্তা দিয়ে আপাতত বড় রাস্তায় গিয়ে পড়া যায় না। আর দরজা
থেকে বেরিয়ে
বাঁয়ে গেলে হাসপাতালের প্রধান দরজার সামনে দিয়ে বাড়ির দিকে আসার হাঁটাপথ। সেদিনও
বাড়ি ফেরার জন্য সেই পথেই পা বাড়িয়েছিলাম। সামনে থেকে আসছিলেন দুজন বয়স্ক মহিলা। একটু
অবাক হয়েছিলাম, ঐদিকের রাস্তা তো আপাতত বন্ধ, তাহলে ওঁনারা যাচ্ছেন কোথায়! ভাবতে
ভাবতেই বন্ধ রাস্তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে ওঁদের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ঐদিক দিয়ে ওঁনারা
বড় রাস্তায় পৌঁছাতে পারবেন কি না। হাসপাতালের সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঐদিকে হেঁটে
যাবার চেষ্টা করছিলেন বোঝাই যাচ্ছিলো। বললাম, যে ঐদিকের রাস্তা আপাতত বন্ধ।
কারণটাও বুঝিয়ে বললাম। তারপর দুজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন আমায় জিজ্ঞাসা করলেন,
"তুমি কি রিসার্চ পার্সন? ল্যাবে কাজ করো?" মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে নিজের পথে পা বাড়াতেই হঠাৎ একটা
এমন কথা শুনলাম যার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বলে উঠলেন, "I owe
you." "আমি তোমার কাছে ঋণী।" আমি জিজ্ঞাসু চোখে ঘুরে দাঁড়াতেই তিনি
বললেন, "তোমরা দিনরাত্রি কাজ করছো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য। তোমাদের
আন্তরিক চেষ্টার জন্যই তো এতো মানুষ আশার আলো দেখছে।" অর্থাৎ কোভিডের ভ্যাকসিন বা এন্টিভাইরাল
ড্রাগ তৈরী করার চেষ্টার জন্য এত রিসার্চ হচ্ছে, আর আমি একজন রিসার্চার তাই আমার
মায়ের বয়সী একজন মানুষ আমায় কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন।
আমি ভাইরোলজিস্ট নই, একজন ক্যান্সার রিসার্চার। আমি কোনো মতেই
সরাসরি এই কৃতজ্ঞতার দাবিদার হতে পারিনা। কিন্তু তবুও সেদিন কিছুই বলতে পারিনি। নন-রিসার্চ
পার্সনের কাছ থেকে কোনো রিসার্চার সরাসরি কোনোদিন তাঁর কাজের জন্য যথাযথ মর্যাদা বা স্বীকৃতি পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। রিসার্চ ইনস্টিটিউটের
অফিসিয়াল স্টাফরা পর্যন্ত রিসার্চারদের কাজের প্রতি উদাসীন। এ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলছে। আমাদের বাড়ির লোকজন পর্যন্ত জানার
চেষ্টা করেন না আমরা ঠিক কি করি। বায়োয়োমেডিক্যাল রিসার্চের প্রতি চিকিৎসকদের যতখানি ওয়াকিফহাল থাকা
প্রয়োজন আমাদের দেশে ঠিক ততখানিই উদাসীনতা দেখে আমরা অভ্যস্ত। উদাসীনতা, হতশ্রদ্ধা, আশাহীনতা, ফান্ডিং না থাকা এমন কি ঠিক সময়ে
ফেলোশিপ না পাওয়াটা পর্যন্ত এতটাই সাধারণ ঘটনা আমাদের কাছে, যে উপরোক্ত ঘটনাটিতে আমি
বেমালুম বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। আমি কেবল একজন রিসার্চার বলে একজন মানুষ আমায় তাঁর
কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন এটি আদ্যন্ত নতুন ঘটনা আমার কাছে! শ্রদ্ধায় মাথা নামিয়ে চলে এসেছিলাম
সেদিন।
অনেকদিন হলো ভাইরাস নিয়ে ঘর করতে করতে
মানুষের ভয় কমে গেছে। আমাদের দেশের মতো এখানেও মানুষ আর সুরক্ষাবলয় মানছেন না। বর্ণবিদ্বেষবিরোধী জনসমাবেশে, শপিং
সেন্টারগুলোতে মাস্ক পরিহিত মানুষের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। ফলে ভাইরাসও তার প্রয়োজন
মতো বংশবিস্তার করছে। অদূর ভবিষ্যতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সমস্ত ধাপ পেরিয়ে মানুষের দেহে
ব্যবহারযোগ্য সুরক্ষিত ভ্যাকসিন আসতে চলেছে কিনা জানিনা। ভারতবর্ষে কোভিডের প্রকোপ কবে কমবে জানিনা। তবে কোভিড- ১৯ সেদিন রিসার্চার গোষ্ঠীর
অন্ততঃ একজন মানুষকে আনন্দে কাঁদিয়েছিল। সারা পৃথিবীর সমস্ত ভাইরোলজিস্টদের আমি তাঁদের প্রাপ্য সেই মর্যাদাটুকু এই
লেখার মাধ্যমে জানিয়ে দিতে চাই। এই স্বীকৃতিটুকু নিশ্চয়ই তাঁদের প্রাপ্য। অনন্ত
উদাসীনতার মাঝেও অন্ততঃ দু একজন মানুষও যে মনে রেখেছেন এই ভুলে যাওয়া বিজ্ঞানকর্মীদের কথা,
এটুকুই এখন অনেকদিনের অক্সিজেন হয়ে থাকবে।
অর্পিতা চ্যাটার্জী
ইউনিভার্সিটি অফ
নেব্রাস্কা মেডিকেল সেন্টার
ওমাহা, নেব্রাস্কা
ইউনাইটেড স্টেটস অফ
আমেরিকা
9th June,
2020