Friday, 6 April 2018

জানালা

ভোরের অন্ধকারে বাড়ি  ফিরতে ফিরতে পাড়ার মোড়ে অভ্যর্থনা করে ভীত দুটো রাকুন। গাড়ীর হেডলাইটের আলোয় চকচক করে ওঠে ওদের চোখদুটো। মাঝরাস্তায় ছুটোছুটি করছিল দুজনে। আমার জন্য খেলায় ব্যাঘাত হল। দৌড়ে রাস্তার পাশে গিয়ে জুলজুল করে দেখতে থাকে আমায়। ভয়ে ভয়ে আর এক ভীতুর দিকে তাকিয়ে থাকে।

আলো ফুটতে থাকে। দিন শুরু হয়। আমি জানলা খুলি, জল গরম করে টি ব্যাগ ডুবিয়ে খাই। দু চুমুক দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে লোক দেখতে দেখতে, লোকেদের সাথে তাদের কুকুরদের দেখতে দেখতে ভুলে যাই  আমি চা খাচ্ছিলাম। আধঘন্টা পরে ঠাণ্ডা চা জলের মতন ঢকঢক করে খেয়ে নি। গলা শুকিয়ে গেছে যে। উঠে গরম করিনা আলসেমি তে। আর ফেলে দিয়ে নতুন করে বানাই না কারণ খাবার জিনিষ ফেলে নষ্ট করতে নেই যে। এখানে আসার প্রথম সপ্তাহেই কি যেন একটা উপলক্ষে বৈকালিক জলযোগের আমন্ত্রণ ছিল ডিপার্টমেন্ট  সুদ্ধু সক্কলের। পার্টির শেষে গামলা ভর্তি নানারকম চিজ, ফলের টুকরো, কেক ইত্যাদি সমস্ত উদ্বৃত্ত খাবার একসাথে ধরে ফেলে দিতে দেখেছিলাম। এই আড়াইবছরে এতকিছু ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও ওই দৃশ্যটা ভুলে যেতে পারিনি। প্রানে ধরে চাটুকু ফেলতেও কেমন লাগে। কিপটেমি? মধ্যবিত্ত বস্তাপচা মানসিকতা? হবে হয়ত কোন একটা।

জানলার বাইরে রোদ বাড়তে থাকে। সপ্তাহান্তের শিথিল জীবন বয়ে চলে আমার জানলার কিনারা ঘেঁষে। আমার আজ "কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই।" কথাও বলার নেই। রাতজাগার ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে যায় কখন কে জানে। গায়ের চাদরটা জড়িয়ে গুটুলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি জানলার পাশে মেঝের কার্পেটেই।  ঘুম আমায় পাহাড়ে নিয়ে চলে। পাহাড়ে তখন বর্ষা নেমেছে। সদ্যস্নাতা পাহাড়ি লতা থেকে টুপটাপ জল ঝরছে। চকচকে কচি সবুজরং চারিদিকে। তিনদিকে ওই তো দেখতে পাচ্ছি সবুজ পাহাড়। আর সামনে ওইতো দূরে নদীপথ আর ছড়ানো গ্রাম। ওইটেই বুঝি আমার গ্রাম, আমার পৌঁছানোর লক্ষ্য। সেই তিন পাহাড়ের জটলার মাঝে দূরের গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল। পৌঁছানোর পথের হদিশ কোথায় যে যাত্রা শুরু করব? তিন পাহাড়ের সংগমে বেভুল হয়ে দূর থেকে কেবল দেখতে থাকি। পৌঁছাতে পারিনা। প্রিয় বর্ষা কেবল গান শুনিয়ে যায় ভিজে বাতাস আর টুপটুপিয়ে পড়া জলের শব্দের আল্পনায়। অনেক বেলায় ঘুম ভেঙে উঠে বসি। বর্ষা, পাহাড়, সবুজ সমস্ত ছাপিয়ে চড়চড়ে রোদ্দুরভরা জানলায় কেবল সত্যি হয়ে থাকে আমার ঘরে ফেরার স্বপ্ন।

উঠে বসে থাকি। জড়বস্তু যেন। খিদে, তেষ্টা নেই। স্নান করার তাড়া নেই। কিছু ভাবারও বুঝি নেই। মস্তিষ্কজাত সমস্ত চিন্তা যেন জলাঞ্জলি দিয়ে বসেছি। শুধু চোখের সামনে যা চলছে, যন্ত্রবৎ তাকে গ্রহণ কর, অনুধাবন কর তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ কর। দিন-মাস-বছর যায়, আমার যন্ত্র থেকে মানুষ আর হয়ে ওঠা হয়না। জানলার ভেতর থেকে দেখতে থাকি জানলার বাইরের সতস্ফুর্ত জীবনস্রোত। জানলা খুলে জীবনের সাথে আলাপ করা আর হয়না।

শেষদুপুরের তামাটে রোদ ক্রমশঃ এলিয়ে পড়ে জানলার বাইরে রাস্তার ওপারে সারি সারি ন্যাড়া গাছগুলোর গায়ে। কয়েকটা গাড়ি যাতায়াত করে। কুকুর নিয়ে দৌড়তে বেরোয় দম্পতি। শীতটা যাবে যাবে করেও যাচ্ছে না এখনো। শেষবেলায় মরণকামড় দেবার মতন। অদ্ভুত সোনালী দেখাচ্ছে গাছগুলোকে। আমি প্রাণভরে দেখতে থাকি গাঢ় নীল আকাশের ক্যানভাসে সোনালী গাছেদের। বিকেল শেষ হতে থাকে। আমার জানলার কাঁচে মাথা কোটে ঠাণ্ডা বৈকালী হাওয়া। অস্নাত, অভুক্ত, চিন্তাশক্তিহীন জড়বৎ আমি কেবল বসে থাকি আলুথালু আমায় আগলে নিয়ে।

হাচিকোপুরান/পর্ব ২/ হাচিকোর দোলযাত্রা (২)

হাচিঃ দাঁড়া, টুকে নিই। এঁ ড়ে ত র্ক। হ্যাঁ হয়েছে। পরে ভাইপোর সাথে কথা কইতে গেলে এই কথাটা চালিয়ে দেওয়া যাবে। বড্ড তক্ক করে কথায় কথায়। ও হ্যাঁ, ওই গরমকালে তরমুজ চোষার কথাটা ভাইপোর কানে তুলিসনি যেন।  অসভ্যের মতন দাঁত দেখিয়ে হাসবে। বড় ত্যাঁদড় হয়েছে দিন দিন মায়ের আশকারায়। এই, এঁড়েতর্ক মানেটা কি রে? এঁড়ে বাছুরের মত তর্ক করা?

দিদিঃ আমি জানি না যা, এঁড়ে বাছুরের মতন তর্ক করা না আনাড়ির মতন তর্ক করা। আমার মা বলে তাই আমিও বললাম।

হাচিঃ খি খি খি খি......তার মানে, তুইও তোর মায়ের সাথে এঁড়েতক্ক করিস। তাই তোর মা বলে। তুই আবার আমায় বলছিস আমি এঁড়েতক্ক করছি। আবার এঁড়েতক্কর মানেও জানিসনা ঠিক করে। আবার আমায় বলিস, আমি কথার মানে না জেনে কথা বলি। তোরা দুপেয়ে মানুষগুলো মাঝে মাঝে দেখাস মাইরি। এই যাহহ, সরি, আবার মাইরি বলে ফেললুম।

আচ্ছা যাক গে যাক চটছিস কেন? আমি তো এমনি বলছিলুম। শোন না, তুইতো আমার মিষ্টি দিদি। আয় একটু কানটা চেটে দিই।

দিদিঃ কেন? এখন কেন? নিশ্চয়ই কিছু মতলব আছে। বাঁদর কোথাকার।

হাচিঃ ওহো, এখনো ঠিক করতে পারলি না আমায় বাঁদর বলবি, না ছাগল বলবি, না গাধা বলবি। কুকুর কিন্তু আমি মোটেও নই বলে দিলুম। আমি দুপেয়ে মানুষ।

(হঠাৎ উদাস হয়ে গিয়ে) যাক আর তক্ক করলুম না। ছেড়ে দিলুম। আজ এমন রঙিন দিন।

দিদিঃ তোর মতলবটা কি বলতো হাচি। হঠাৎ এত উদার হয়ে গেলি?

হাচিঃ ইয়ে মানে বলি? বল?

দিদিঃ ভ্যানতারা বাদে আবেদনাদি নিবেদিত হোক।

হাচিঃ ইয়ে, বলছি কি, ওই রঙ খেলার সাথে যে মিষ্টিগুলো খাচ্ছিলো ওরা, তার চাট্টি হবে নাকি রে?

দিদিঃ তাই বলো,খাওয়া ছাড়া এতো ভ্যানতারা তো করবে না। তোমায় আমি চিনি না।

হাচিঃ হেঁহেঁ, আছে নাকি রে?

দিদিঃ আছে দাঁড়া। কিন্তু তার জন্যে কিন্তু একটু আবীর মাখতে হবে। দোলের দিন আবীর মাখিয়ে তবে মিষ্টিমুখ করাতে হয়।

হাচিঃ আবীর? আবীর মানে? আচ্ছা বাদ দে। আবীর না কি বললি ওটা নিয়ে যা করার করে চটপট মিষ্টিটা দে দিকিন। খাবার কথা উঠলে আমি আবার লেজটা থামিয়ে রাখতে পারি না। আপনা থেকেই ঝড়ের মত দুলতে থাকে। দেখ না কিছুতেই থামাতে পারছি না। দে দে।

দিদিঃ দিচ্ছি দাঁড়া না রে হ্যাংলেশ্বরের মরণ। আগে আবীরটা দিয়ে নিই কপালে? কোন রংটা লাগাব বল? লাল আছে, সবুজ আছে, গেরুয়া আছে, হলুদ আছে, গোলাপী আছে।

হাচিঃ আরে ধুর সব গুলিয়ে দিলি আবার। কোন রংটা লাগালে বেশি মিষ্টি দিবি? নালে ঝোলে একাক্কার এখন, এরমধ্যে এই রঙ, সেই রঙ। যে রঙ এ বেশি মিষ্টি সেটাই দে।

দিদিঃ বেশি কম কোথাও নেই। একটাই পাবে যে কোনো রঙ এই। কোন রংটা পছন্দ বল।

হাচিঃ ধুর ছাতা, দেনা যা খুশি একটা। সবেতেই যখন একটাই মিষ্টি পাব তখন আর পছন্দ অপছন্দ কি? মিষ্টিটা শুধু দে তাড়াতাড়ি।

অতঃপর হাচিকো তার কালো কপাল আর সুঁচালো কালো নাকের উপর বৃহৎ একখানি হলুদ টিকা লইয়া গুজিয়া ভক্ষন করিতে লাগিল।

Monday, 2 April 2018

হাচিকোপুরান/পর্ব-২/হাচিকোর দোলযাত্রা

দোলের দিন বৈকাল, হাচি আসিয়াছে দিদির বাড়ি-

দিদিঃ হ্যাঁ রে হাচি, সবাই রঙ খেললো তোকে কেউ রঙ দিলো না একটুও?

হাচিঃ না না। ওসব রঙ মাখামাখির মধ্যে আমি নেই। হ্যাঁ তবে ওই রঙের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কিসব খাচ্ছিলো দেখলুম, ওটা বেশ ভাল ছিল।

দিদিঃ কি, ও গুজিয়া? তুই খেলি বুঝি? কে দিলো?

হাচিঃ এঁহ, কে আবার দেবে? তোরা যেন আমার জন্যে মিষ্টির দোকান খুলে বসে আছিস? টেবিলের নিচে একটা পড়ে গেছিল, তা গুঁড়ি মেরে টেবিলের তলায় ঢুকে একটা কামড় বসিয়েছি কি বসাইনি, ছিটেলগুলো জলের বালতি নিয়ে তাড়া করলো মাইরি!

দিদিঃ জলের বালতি? ধুর গাধা, রঙের বালতি বল। আর হ্যাঁ, কতবার তোকে বলেছি এসব মাইরি টাইরি বলবি না আমার সামনে। আমার ভাল্লাগেনা।

হাচিঃ কেন বললে কি হয়? মাইরি মানে কি রে?

দিদিঃ তুই মানে না জেনেই বেতালার মতন কথাটা বলে যাচ্ছিস? বলতে বারণ করছি বলবিনা ব্যস। আচ্ছা বেয়াদব কুকুর তো।

হাচিঃ আবার? আবার কুকুর বলছিস আমায়? আমি কুকুর?

দিদিঃ কুকুর না তো কি তুমি? ছাগল কোথাকার।

হাচিঃ উফ এই জন্যেই বলি তোদের এই দুপেয়ে মানুষগুলোর মাথার ঠিক নেই। পিত্তের দোষ, সব পিত্তের দোষ। আগে  ঠিক কর আমায় কুকুর বলবি না ছাগল। যদিও কোনোটাই আমি নই।

দিদিঃ তবে তুমি কি? গাধা কোথাকার।

হাচিঃ অই দেখ! সাধে বলছি পিত্তের দোষ। আমি হলুম গে চারপেয়ে মানুষ।

দিদিঃ হ্যাঁ রে গাধা! তবে পেছনে ওই কালো লম্বা পানা ওটি কি? খাবারের গন্ধেই নড়তে থাকে?

হাচিঃ ওটিই তো তোর সাথে আমার তফারেন্স। তোর নেই আমার আছে। দুপেয়ে মানুষদের থাকে না। চারপেয়ে মানুষদের থাকে। বুঝলি?

দিদিঃ এই দাঁড়া দাঁড়া দাঁড়া দাঁড়া দাঁড়া!  কি বললি?

হাচিঃ (ঘাবড়ে গিয়ে) কি বললুম আবার?

দিদিঃ তোর সাথে আমার কী?

হাচিঃ কি?

দিদিঃ তোর সাথে আমার কী বললি?

হাচিঃ অ, ওইটা? 'তফারেন্স'। মানে বুঝলি না তো? কিই যে পড়াশুনা শিখেছিস? কিছুই তো জানিস না।  তফারেন্স মানে হল তফাৎ,  ডিফারেন্স। 

দিদিঃ মানে টা কি? তুই একটা শব্দের অর্ধেকটা বাংলা আর অর্ধেকটা ইংরাজি করে বলবি? আবার বলবি আমি পড়াশুনা জানি না! আশ্চর্য তো!

হাচিঃ কেন হবে না কেন? সবকটা দুপেয়ে কে দেখি, অর্ধেকটা বাংলা আর অর্ধেকটা ইংরাজি মিশিয়ে কথা বলে। তুই ও তো বলিস- "বোরড লাগছে রে হাচি"(ভেঙচিয়ে), বলিস না? বল সত্যি কথা। কেন 'মনখারাপ করছে' বলতে পারিস না? আর আমি বললেই দোষ?

দিদিঃ দুটো ব্যাপার এক নয়। তুই ওরকম একটা শব্দে দুটো ভাষা মেশাতে পারবিনা ব্যস।

হাচিঃ আরে সেটাই তো শুধুচ্ছি রে ছিটেল কোথাকার। কেন? কেন পারব না? একটা বাক্যে দুটো ভাষা মিশতে পারলে একটা শব্দে পারবে না কেন? আমি তো ভাবছিলুম বাংলা, হিন্দি, মালায়লম আর ইংরাজি মিশিয়ে একটা ভাষা বানালে কেমন হয়?

দিদিঃ দুর্দান্ত হয় রে ছাগল। পরের বছর ভাষাদিবসে তোকে সাহিত্যে নোবেল আর ভারতরত্ন মিশিয়ে নোভেলরত্ন দেবে রে পণ্ডিত এজন্য।

হাচিঃ কয়েকটা শব্দের মানে যদিও এখন বুঝতে পারলুম না তবু মনে হচ্ছে কটু কথাই বলছিস। কেন রে? আমরা চারপেয়ে মানুষদের নতুন ভাষা। ভাল হবে না বল?

দিদিঃ আহা শুনে কানে বাতাস লাগল। এঁড়েতক্ক করবিনা হাচি। এসব গাধামি বাদ দাও। এসব হয়না।

হাচিঃ এই তোদের ছিটেল দুপেয়েগুলোর দোষ, জানিস তো। যা আজীবনকাল থেকে চলে আসছে, তাতে একটু কিছু অন্যরকম হলেই পাগলা জগাই এর মতন তেড়ে আসিস। কোথায় সবাই মিলে দেখবি ব্যাপারটা কিরকম দাঁড়াচ্ছে, তা না। পরে খারাপ লাগলে নাহয় ত্যাগ দিবি। এই যেমন আমি, মাংস ছাড়া অন্য কিছু আমাদের শাস্ত্রে খাওয়া মানা। তাবলে কি আমি তোর সাথে গরমকালে তরমুজের টুকরো চুষে দেখিনি? দিব্য খেতে, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা।  যাক গে যাক।  এসব তোরা দুপেয়েরা বুঝবি না। কাজের কথাটা শুধোই। ওই যে কি যেন একটা তক্ক বললি, ওটা কি রে? বলতো আরেকবার।  নোটবইতে টুকে রাখি। নতুন বাংলা শব্দ, এটা জানি না।

দিদিঃ এঁড়ে তক্ক, মানে এঁড়েতর্ক।

হাচিঃ এঁড়ে?  মানে ড এ শূন্য ড়?

দিদিঃ হ্যাঁ।

(চলবে)