বাড়িতে একটা ঘর আছে, সেখানে দুটো মাটির উনুন আছে। যদিও চলতি কথায় তাদের কাঠের উনুন বলে ডাকা হয়। কারণ কাঠ কুটো জ্বাল দিয়ে সেখানে রান্নার ব্যবস্থা। অনেক আগে এগুলিই ছিল আমাদের বাড়ির একমাত্র রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। সময়ের সাথে সাথে কাঠের উনুন থেকে গুল-কয়লার আঁচের উনুন, পাম্প দেওয়া স্টোভ-পাম্প না দেওয়া স্টোভ-গ্যাস-ইনডাকশন ওভেন পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে আমার মায়ের হেঁসেল। কিন্তু সে ঘর- সে উনুন এখনো আছে তার অটুট স্বাস্থ্য নিয়ে। সে উনুন ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির জোগাড়ও আছে। প্রতিদিনের অল্প ব্যবহারের সাথে সাথে এখনো বছরের দুটো দিন তারা মহানায়ক এর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যে কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে সেটা এই উনুন নিয়ে নয়, উনুন এর ধোঁয়া নিয়ে।
অনেক ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে। বিনা কারণে হাঙ্গরের মত হাঁ করে কান্নাকাটি আর আদরে-আহ্লাদীপনার বিলাসিতার পর্ব পার করে এসে তখন সদ্য স্লেট-পেন্সিলে পড়েছি। সকাল-বিকেল পড়তে বসা রান্নাঘরে। কারণ মায়ের তাতেই সুবিধা। একখানা আসন ছিলো, মায়েরই হাতে বোনা। সবুজ রঙের উল দিয়ে চৌখুপি-মধ্যে আট পাপড়িওয়ালা লাল উলের ফুল। ধারগুলো মায়ের শাড়ির পাড় কেটে বাঁধানো। আমার পড়তে বসার আসন। আর বইখাতা বলতে, একখানা নামতার বই, বর্ণপরিচয়, হাসিখুশি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যবই, সঙ্গে আমার অধিকারে থাকা কথামালা, ঈশপ-এর গল্পের একরঙ্গা ছবির বই -ইত্যাদি সমস্ত রকম গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হতাম সকাল বিকেল। তারপর ঘন্টা দুই তিন রাম-রাবণের যুদ্ধ সেরে যখন আবার পাততাড়ি গুটিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতাম ততক্ষণে ফ্রকের ঝুল দিয়ে ভিজে চোখ মুছতে গিয়ে কেমন একটা গন্ধ পেতাম। ধোঁয়ার গন্ধ। সেই একই গন্ধ পেতাম মায়ের শাড়িতে রাতের বেলা মাকে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে শোবার সময়।
শীতের দুপুরে বেলাশেষের আগে তড়িঘড়ি রাতের রান্নাবান্না সেরে ঘরে ঢুকে পড়ার একটা তাড়া থাকত সব বাড়িতেই। প্রায় সমস্ত বাড়িতেই তখন রান্নাঘরগুলো ছিল বাড়ির বাইরের দিকে। শীতকালে আশেপাশের সমস্ত বাড়ি থেকেই তাই শীতের বিকালবেলা বেরিয়ে আসতো ধোঁয়া। সঙ্গে ধোঁয়ার গন্ধ। ভারী হয়ে ভেসে থাকত, আস্তরণ তৈরী করত আমাদের খেলার মাঠের ওপর। শীতকালে খেলতে যাবার আগে জুতো-মোজা, হলুদ-কালো হনুমান টুপির সাথে আবশ্যক ছিল বোরোলিন বা পন্ডস কোল্ড ক্রিম। সুতরাং শীতের ছোট্ট বিকেলে বাড়ির পাশের খামারে বৌবসন্ত বা পিট্টু খেলার আর বোরোলিন বা পন্ডস কোল্ড ক্রিমের গন্ধের সাথে মিশে গেছে সেই গন্ধ। ধোঁয়ার গন্ধ। অঘ্রাণে ধান কাটা হলে, আমাদের বৌবসন্ত বা পিট্টু খেলার জায়গা দখল করে তিনচারটে বাড়ির ধানের গাদা বসত খামারে। আমাদের তখন ধানের গাদার ফাঁকে ফোঁকরে লুকোচুরি খেলার দিন। আর আমাদের সাথে পাল্লা দিতে তখন সব বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ারাও একজোট হয়ে স্তরে স্তরে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুরে বেড়াত ধানের গাদাগুলোর ফাঁকে-ফোঁকরে। পুরনো হিন্দি সিনেমায় স্বপ্নের দৃশ্য দেখাবার জন্য যেমন ধোঁয়ার একটা আস্তরণ তৈরী করা হয়, প্রায় তেমনি একটা দৃশ্য তৈরী হত খামারে। তফাৎটা এই যে এক্ষেত্রে ধোঁয়াটা পায়ের দিকের জায়গায় মাথার ওপরে। তার মাঝে লুকোচুরি খেলার চোরের গলায় ভেসে আসত "অমুক, এক পাঁচ"। এই "এক পাঁচ" কথাটা যে ঠিক কেন বলা হত তা আমি জানি না আজও।কথার মানে, অমুক নামের লোকটি নিজেকে আড়ালে রাখতে পারল না। আর আমি তখন অন্য আর একটি ধানের গাদার পিছনে নিজেকে লুকিয়ে রেখে ধোঁয়া আর কখনো কখনো তার সাথে মিশে আসা সরুচাকলি পিঠের গন্ধ নিচ্ছি।
সরুচাকলি বানাতো মা। এখনো বানায়। গ্যাসের ওভেনে। তাই তাতে কখনো ধোঁয়ার গন্ধ হয় না আর। আগে মাঝে মাঝে পেতাম। সাথে দুই এক টুকরো ছোট্ট পোড়া কুটো। উনুনের অবদান। রাতের রান্না সেরে পড়ন্ত উনুনে রাখা থাকত একহাঁড়ি ভর্তি জল। ধিকিয়ে ধিকিয়ে যতটুকু উত্তাপ সে দেবে তা রাতে খাবার শেষে মুখ হাত ধোবার জন্য ওই এক হাঁড়ি জল গরম হবার পক্ষে যথেষ্ট। আর মাঝে মাঝে ওই পড়ন্ত উনুন এর পাশে বসত পড়ার আসর। উনুনের গরমে আরামদায়ক হয়ে থাকত রান্নাঘরটা।
কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেকার ধোঁয়ার গন্ধমাখা শীতের বিকেলবেলার কথা আজ মনে পড়িয়ে দিল সামান্য এক চিমনির ধোঁয়া। বাইরে শীতের হাওয়া। পাশের বিল্ডিং এর চিমনি থেকে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসছিল সাদা ধোঁয়া। উনুনের নয় নিঃসন্দেহে। এরা কাঠ পুড়িয়ে রান্না করে না আর। আমিও ছিলাম। বিকেলের খেলার সঙ্গীদের সাথে ধানের গাদায় লুকোচুরি খেলার মাঠে নয়, কোনো এক কাজ পালানো অবসরে ঢাকা দেওয়া কাগজের কাপে বিস্বাদ কফি সঙ্গী করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক কাফের কাঁচের জানলার পাশের চেয়ারে বসে। বোরোলিন-সরুচাকলি মাখা ধোঁয়ার গন্ধের বদলে বাতাসে ছিল চীজ-মায়োনিজ-কফির মিশ্র গন্ধ। তবুও কেন যে একশো কথার ফাঁকে মনে পড়ে গেল সেই ধোঁয়া মাখা বিকেলগুলোর কথা কে জানে। কফির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দেখছিলাম গলগলিয়ে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ারা ব্যস্ত হয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। কোনো সমান্তরাল আস্তরণ তৈরী না করেই। হয়ত এখানে ধানের গাদায় লুকোচুরি খেলার কেউ নেই বলেই। হয়ত খেলতে খেলতে ধোঁয়ার সাথে সরুচাকলি পিঠের গন্ধ নেবার কেউ নেই বলেই। কে জানে।